সৃষ্টি পঞ্চভূতাত্মক।এতে তত্ত্বের সমাবেশ ঘটেছে।এই পাঁচটি তত্ত্ব হল – ভূমি, অগ্নি, বায়ু, পানি ও আকাশ।ঠিক একইভাবে মানুষের শরীরেও এই পাঁচটি তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে।একইভাবে পৃথিবীর ওপর যে কোনও ধরণের নির্মাণ এই পাঁচটি তত্ত্বের ওপর গড়ে ওঠে।সুতরাং স্থূল ও সূক্ষ্ম উভয়ার্থেই এই তত্ত্ব কার্যকরী।মানুষ তার নিজের বুদ্ধিতেই এই তত্ত্বের রহস্য জেনেছে।কিন্তু এই পঞ্চভূতের সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য অন্তঃসম্বন্ধকে নিজের ইচ্ছানুসারে সামঞ্জস্য করার ক্ষমতা তার সাধ্যের বাইরে।

সুতরাং প্রকৃতির পঞ্চভূতাত্মক ব্যবস্থাকে ব্যাহত না করে আমাদের চলতে হবে।যদি ওই ব্যবস্থায় কোনও রকমের নাক গলানো হয় তা হলে অনেক রকমের অঘটন বা বিপদ দেখা দিতে পারে।বাস্তুশাস্ত্রের নিয়মগুলি পড়লেই বুঝা যাবে, প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য করে আমরা যদি আমাদের বাসস্থান বা কর্মস্থলের নকশা তৈরী করি, তা হলে সেখানকার বাসিন্দা বা কর্র্মীদের মধ্যে পারস্পরিক মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং জীবন কাটবে অপার সুখশান্তিতে।

বাস্তুর নিয়ম অথবা সিদ্ধান্ত গুলির পিছনে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।শুধু তাই নয়, এর পিছনে রয়েছে গভীর বিজ্ঞানভিত্তি। পৃথিবীর ওপর সূর্যরশ্মির প্রভাব ,পৃথিরীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র, বাতাসের গতি ও তার প্রভাব ইত্যাদি এমন কিছু বস্তু আছে যেগুলির ওপর সম্পূর্ণভাবে নজর দেওয়া হয়েছে।

আমরা জানি ভোরের সূর্যরশ্মি মানুষের জীবনের পক্ষে অনেক উপকারী।কিন্তু সেই সূর্যের রশ্মিই মধ্যাহ্নের পরে অতটা উপকারী নয়, বরং ক্ষতিকারক।

আকাশ:অনন্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডে রয়েছে অসংখ্য গ্রহনক্ষত্র।পৃথিবী তাদেরই মধ্যে একটি গ্রহ।বিশ্বব্রহ্মান্ডের অনন্ত মহাশূন্যেরই একটি স্থানে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় বিরাজ করছে সে।আমাদের এই পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে যে অসংখ্য গ্রহনক্ষত্র অবস্থান করছে সেই মহাশূন্যকেই আমরা বলি আকাশ বা স্পেস।

মহাশূন্যে প্রতিনিয়ত চলছে রহস্যলীলা।মহাশূন্যে নানা গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব পৃথিবীর বুকে প্রভাবিত হচ্ছে।পৃথিবীর প্রাণিজগতের ওপরও এর প্রভাব প্রতিফলিত হয় নিরন্তর।পৃথিবীর বুকে আসছে আলো, তাপ, চৌম্বক শক্তি এবং নানাবিধ শক্তি।

মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।এ সবের জন্যেই পৃথিবীর বায়ুমন্ডল বা সমুদ্রে এবং নদীতে তৈরি হচ্ছে ঢেউ।প্রাণিজগতের ওপরও এই সমস্ত প্রভাব সদাসর্বদাই পড়ছে।জীবনের ওপর প্রভাব, বিশেষ করে মানবজীবনের ওপর প্রভাব নিয়েই জ্যোতিষশাস্ত্র বা জ্যোতির্বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে।জ্যোতিষশাস্ত্র সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু, কেতু ইত্যাদি গ্রহের এবং রাশির সঙ্গে সম্পর্কিত।গ্রহনক্ষত্র এবং রাশিচক্র পৃথিবীর জীবনের ওপর প্রভাবিত।আকাশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শব্দ।

বায়ু:আমরা জানি বায়ু হল বিভিন্ন গ্যাসের সমন্বয়।পৃথিবীতে এই বাতাসে আছে অক্সিজেন – ২১ শতাংশ, নাইট্রোজেন – ৭৮ শতাংশ আর বাকি অংশে আছে অন্যান্য গ্যাস – হিলিয়াম,নিয়ন,আর্গন, কার্বন ডাইঅক্সাইড ইত্যাদি।এই বায়ু প্রাণিজীবনের প্রধান অঙ্গ।তার কারণ বায়ু ছাড়া কোনও প্রাণের অসি-ত্ব সম্ভব নয়।আর এই বায়ু আছে বলেই পৃথিবীর বুকে শব্দ সৃষ্টি হয়েছে।বায়ু শব্দকে বহন করে আর বায়ু থেকেই আসছে অনুভূতি বা স্পর্শ।এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্পর্শ এবং শব্দ।

অগ্নি:অগ্নি হল সমস্ত শক্তির উৎস।সৌরশক্তি, বৈদ্যুতিক শক্তি, আণবিক শক্তি এবং প্রাণিজ শক্তি – সবই আমরা পাই অগ্নি থেকে।আর এই অগ্নি থেকে সৃষ্টি তাপ আর আলোর।তাপ এবং আলোবিহীন জীবন আমরা ভাবতেই পারি না।এর বৈশিষ্ট্য হল শব্দ, স্পর্শ ও রূপ।

পানি:প্রাণীজীবনে অন্যতম এবং মূল্যবান উপাদান হল পানি।সম্প্রতি জানা গিয়েছে যে চাঁদে এক ফোঁটা পানি নেই।ফলে সেখানে কোনও প্রাণের অস্তিস্ত্বও নেই।আমাদের পৃথিবীর পানি আছে বলেই প্রাণের এত পাচুর্য।প্রকৃতির বুকে এত সবুজের সমারোহ।গাছ-গাছালি, মানুষ, পাখি, জীবজন্তু প্রত্যেকেরই পানি অত্যন্ত প্রয়োজন।এই পৃথিবীর তিন ভাগ পানি আর এক ভাগ স্থল।আমাদের শরীরে যে রক্ত প্রবহমান, তার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে আছে হিমোগ্লোবিন ও অক্সিজেন।রক্তের মধ্যে সেই পানিই বিরাজ করছে।আবার পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখুন খাল, বিল, নদী, নালা, সমুদ্র, এমনকি আকাশের মেঘ, বৃষ্টি-সবার মাঝেই রয়েছে পানি।আর এই পানির জন্যই পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে রসের।পানির বৈশিষ্ট্য হল শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস।

ধরিত্রী : ধরিত্রী বা পৃথিবী হল বৃহৎ একটি চুম্বক যার মধ্যে আছে উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু।এর জন্যেই সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিধ আকর্ষণ।পৃথিবীর এই চৌম্বকক্ষেত্র জুড়ে রয়েছে মাধ্যকর্ষণ শক্তি।আর এর থেকেই পৃথিরীর সমস্তবিষয়ে চেতন এবং অবচেতনের ফল লক্ষ করা যায়।অর্থাৎ জাগতিক এবং অজাগতিক শক্তি পরিলক্ষিত হয়।ধরিত্রী বা পৃথিবীর দুই প্রান্ত সাড়ে তেইশ মধ্যাহ্নিক অবস্থায় আছে যার জন্য বছরের ছয় মাস উত্তরায়ণ এবং বাকি ছয় মাস দক্ষিণায়ন।পৃথিবী তার নিজের অক্ষে অর্থাৎ মেরু রেখার পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরছে।ফলে সৃষ্টি হচ্ছে দিন এবং রাত্রির।আর পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে তার কক্ষপথ ধরে সম্পূর্ণ পরিক্রমা করতে সময় নিচ্ছে প্রায় ৩৬৫ ১/৪ দিন অর্থাৎ এক বৎসর।আগেই বলা হয়েছে পৃথিবীর তিনভাগ পানি আর একভাগ স’ল।ধরিত্রীতে এই পাঁচটি গুণই বর্তমান।যথা- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ।

চিত্র:

উপরের ছবি থেকে যে বৈশিষ্ট্য পাচ্ছি তাতে উত্তর-পূর্ব দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহাজাগতিক শক্তি এই অংশেই পুঞ্জিভূত রয়েছে।

চিত্র:

পৃথিবী প্রতিনিয়ত উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে ঘুরছে।ঘূর্ণায়মান অবসস্থায় উত্তর-পূর্ব দিকেই কাত হয়ে আছে।ভুমি, পানি, প্রকাশ, বায়ু ও আকাশের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ।তাই আদিকাল থেকেই মানুষ বিচার-বিবেচনা করে ঠিক করেছিল যে, পুর্ব এবং উত্তর দিকে এরকম কোনও কিছু নির্মাণ বা বৃক্ষরোপণও অনুচিত যার ফলে সূর্যকিরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়।পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে উত্তর দিকে ফাঁকা জায়গা রাখার অর্থ কী, কেননা সূর্যকিরণ তো পূর্ব দিক থেকে আসে।

আমরা সকলেই জানি, সূর্য সারা বছর একই পথে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পরিক্রমণ করে না।একবার সে যায় উত্তরের পথে, আর একবার দক্ষিণপথে।প্রতি পথেই সে ছয়মাস ধরে নিয়মিত পরিক্রমণ করে।উত্তরের পথে পরিক্রমণ করে ২২ শে ডিসেম্বর থেকে ২১ শে জুন পর্যন্ত।এই সময়কে বলে সূর্যের উত্তরায়ণ।আবার দক্ষিণের পথে পরিক্রমণ কাল ২১ শে জুন থেকে ২২ শে ডিসেম্বর।এই সময়কে বলে সূর্যের দক্ষিণায়ন।সূর্য হল নেত্র, বায়ু হল প্রাণ, অন্তরিক্ষ হল আত্মা আর পৃথিবী হচ্ছে শরীর।সমস্ত জগতের আত্মাস্বরূপই হল সূর্য।সমস্ত প্রাণীর প্রাণশক্তির মূল কারণ হল সূর্যরশ্মি।সূর্য তার দিব্য এবং অমৃতরস দিয়ে সমস্ত প্রাণীর জীবন দান করে।

আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে সূর্যরশ্মি বিভাজিত হয়েছে সাতটি রঙে।এর মধ্যে লাল উজানি রশ্মি হিতকর এবং অতিবেগুনি রশ্মি ক্ষতিকর।আধুনিক বিজ্ঞানীদের এই তথ্য প্রমাণের বহু হাজার বছর আগেই পবিত্র কোরআন শরীফে সূর্যরশ্মি সাতটি রঙে বিভক্ত তার উল্লেখ আছে।উদ্যন্ন এবং আরোহ শব্দ দুটি থেকে দুপুরের আগের সূর্যরশ্মি শরীরের পক্ষে শুভকর, এটি স্পষ্ট।

চিত্র:

আধুনিক বিজ্ঞানের মতে এই সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সূর্য এক বিরাট ভুমিকা পালন করে চলেছে।এও বলা যেতে পারে, পৃথিবীর সৃষ্টির কারণ ভূত ও আধারভূত।পৃথিবী থেকে সূর্যের দুরত্ব ১৪৯৬ কোটি কিলোমিটার। প্রতি সেকেন্ডে ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার গতিতে সমানে ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে সৌরশক্তির স্রোত।পৃথিবী সৌরশক্তির দু’কোটি অংশের মধ্যে একটি অংশ লাভ করে।সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ ৭১ হাজার ২৬ ওয়াট শক্তি নির্গত করে।সূর্যরশ্মিতে এমন অনেক পদার্থ আছে যা মানুষ, জীবজন্তু ও গাছপালার বেঁচে থাকার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।এই সৌরশক্তির জন্যই পানি বাষ্প হয়ে মেঘের সৃষ্টি হয় এবং বৃষ্টি হয়।এই রশ্মিই আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন তৈরি করে। সৌররশ্মি এমন অনেক কীটপতঙ্গ ধ্বংস করে দেয় যা আমাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর ও নানা রকম রোগ সৃষ্টিকারী।

প্রাকৃতিক চিকিৎসায় সূর্যরশ্মিতে নিহিত বিভিন্ন রং দিয়ে অনেক রকমের চিকিৎসাও হয়।আয়ুর্বেদ মতে মানুষের শরীরের পাঁচটি প্রধান ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে পঞ্চভূতের।এ তথ্য নতুন নয়।ভূমি, আকাশ, বায়ু, পানি, অগ্নি ও ধরিত্রীর সঙ্গে মানবের নিগূঢ় সম্পর্কের কথা পূর্বের পাতায় ছবি এবং নীচের দুটি তালিকার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হল।

পঞ্চতত্ত্বক্রিয়াউন্দ্রিয়শক্তির স্বরূপতত্ত্ব
অগ্নিদৃষ্টিচোখসূর্যঅগ্নী
বায়ুস্পর্শত্বকবায়ুবায়ু
আকাশশব্দকানবর্ষাপানি
পৃথিবীঘ্রাণনাকচৌম্বকশক্তি/মাধ্যকর্ষণপৃথিবী
পানিস্বাদজিভশব্দআকাশ

উপরোক্ত তালিকা ও ছবি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান, চক্রে নিহিত তথ্যাদি বুঝার জন্য সক্রিয় মনের প্রয়োজন।সক্রিয় মননশীলতার অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে জীবনের সঙ্গে যেহেতু পাঁচটি তত্ত্ব মন আর জীবনই আমাদের অস্তিত্বের কারণ। তত্ত্ববেত্তাদের শাস্ত্রীয় মতে পাঞ্চতত্ত্ব চারটি বিভিন্ন দিকে কীভাবে বিদ্যামান তা নীচের চিত্রের সাহায্যে বুঝানো হল।

চিত্র:

শাস্ত্রীয় মতে পাঞ্চতত্ত্ব চারটি বিভিন্ন দিকে কীভাবে বিদ্যমান তা নীচের চিত্রের সাহায্যে বুঝানো হল।

Pin It on Pinterest

Shares
Share This